নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল যুবদল নেতা মারুফ আহম্মেদ নান্না অন্যকে ফাঁসাতে আদালতের কাঠগড়ায় দাড়িয়ে প্রতারণার গল্প কাহিনী সাঁজানোর ভঙ্গিমায় খোদ বিচারক বিস্মিত হলেন। তার পক্ষে অন্তত পাঁচজন সনামধন্য আইনজীবী সাফাই গাইলেও বিচারক তা আমলে না এনে নান্নার আগাম জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠিয়ে দেন। বন্ধুর পাসপোর্ট জালিয়াতির মামলায় নির্ধারিত কার্যদিবসে আজ বৃহস্পতিবার সকালে বরিশাল চীফ জুডিশিয়াল আদালতে নান্নার এই চাতুরতার কারণে দুই পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে দীর্ঘ সময় যুক্তিতর্কে সেখানে জনকীর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়। আদালত সূত্র বলছে, এ ধরনের একটি মামলা নিয়ে সমসাময়িককালে শুনানির এই দীর্ঘতা বিরল ঘটনা। একই সাথে আদালত পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে নান্নাকে একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এয়ারপোর্ট থানা পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই এনামুল হোসেন আজ সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, আগামী শনিবার আসামি নান্নাকে রিমান্ডে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হবে। কীভাবে তিনি পাসপোর্ট জালিয়াতির আশ্রয় নিলেন এবং তার সাথে কারা সম্পৃক্ত তা উদঘাটনে জোর দেয়া হবে।
উল্লেখ্য, নগরীর আমতলা রোডের বাসিন্দা এবং বর্তমান বগুড়া সড়কে বসবাসকারী ফয়সাল আহম্মেদ গত ২২ জুলাই মারুফ আহম্মেদ নান্নার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগ এনে বরিশাল আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। আদালত বাদীর আর্জি আমলে নিয়ে এয়ারপোর্ট থানা পুলিশকে তা এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে আসামিকে আটকের নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই নান্না পলাতক ছিলেন।
স্থানীয়রা জানায়, নান্না একসময় তার নিজ গ্রাম সদর উপজেলার সাহেবেরহাট থেকে একটি নারী কেলেংকারির ঘটনায় এলাকা থেকে বিতারিত হয়ে বন্ধু ফয়সাল আহম্মেদের বাসায় আশ্রয় নেন এবং দীর্ঘ আট বছর সেখানে আত্মীয়র ন্যায় বসবাস করেন। ফয়সালের আপন খালাতো বোনের সাথে অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকাবস্থায় হাতে-নাতে ধরার পর ওই বাসা থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়। সেই থেকে নান্নার সাথে ফয়সালের শীতল লড়াই চলছিল।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ফয়সাল আহম্মেদ জানান, সময় বিশেষ প্রতিষ্ঠানের মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ে ভাই সমতুল্য নান্নাকে আপন ভেবে তার কাছে ব্যাংকের চেকসহ অন্যান্য কাগজপত্রাদি রেখে তাকে বিভিন্নস্থানে পাঠানো হতো। ধারনা করা হচ্ছে, ওই বাসা থেকে বের করে দেয়ার আগে বরিশাল গির্জামহল্লা শাখা আল আরাফাহ ব্যাংকের ফয়সাল আহম্মেদ’র ব্যাংক হিসাবের স্বাক্ষরিত একটি চেক নান্না সরিয়ে রাখে। তাছাড়া বন্ধু ফয়সালকে চাকরি দেয়ার নামে তার জাতীয় পরিচয়পত্র, জীবনবৃত্তান্ত ও ছবিসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি নেয়। একপর্যায়ে সেই কাগজপত্র ও ফয়সাল আহম্মেদের নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে নান্না নিজের ছবি বসিয়ে একটি পাসপোর্ট তৈরি করেন।
বরিশাল পাসপোর্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা জানান, এ ধরনের পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দফতরের কেউ না কেউ তাকে সহায়তা করেছে। বিষয়টি তারাও খতিয়ে দেখছেন। ফয়সাল আহম্মেদ ভারতে চিকিৎসা নেয়ার উদ্দেশ্যে পাসপোর্ট তৈরি করতে গেলে এই জালিয়াতি ধরা পড়ে। এ সংক্রান্তে তিনি কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশকে অবহিত করলে ফয়সাল আহম্মেদকে আদালতে স্মরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। তারই আলোকে গত ২৩ জুলাই এই জালিয়াতির মামলাটি দায়ের হয়।
মামলার সূত্র ধরে সংবাদকর্মীরা টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নান্নার অতীত এবং বর্তমান জীবনকাহিনী খুঁজতে গিয়ে বিস্ময়কর সব তথ্য-উপাথ্য খুঁজে পায়। তিনি এ ধরনের একাধিক প্রতারণার সাথে জড়িত থাকার কথা স্থানীয়রাই স্বীকার করে বর্ণনা দিয়ে প্রতিটি ঘটনা তুলে ধরেন। নান্না তার নিজ স্ত্রীর সাথেই প্রতারণা করে ৮ বছরকাল তাকে প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত এবং দুরত্ব বজায় রেখে চলছেন, এমন অভিযোগ তার স্ত্রী এলিচ এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার চেয়েছেন। এদিকে ফয়সাল আহম্মেদের খালাতো বোন লাকী আক্তারের সাথে সেই পরকীয়া প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে নলছিটির ঝুড়কাঠির বাড়িতে যাতায়াতের একপর্যায়ে তার মেয়ে সাথী আক্তারকে সম্প্রতি বিয়ে করেন নান্না। সেখানেও তিনি বিবাহিত বিষয়টি গোপন করে আরেকটি প্রতারণার আশ্রয় নেন।
‘আত্মীয়র ভেতরে শত্রুর প্রবেশ’ এই বিষয়টি ফয়সাল আহম্মেদ মানতে না পারায় প্রতিবাদ করায় আকস্মিক নান্না অভিযোগ তোলেন যে, তার একসময়ের এই বন্ধুর কাছে তিনি ২৪ লাখ টাকা আয়ারল্যান্ডে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দিয়েছিলেন। কিন্তু পাঠাতে ব্যর্থ হওয়ায় তার টাকা পরিশোধে একটি চেক দেয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেই চেকটি আল-আরাফাহ ব্যাংকের। ওই চেকটি অনলাইনের মাধ্যমে ডিজনার করে মামলার প্রস্তুতিমূলক ফয়সাল আহম্মেদ বরাবর একটি উকিল নোটিশ পাঠান।
ধারনা করা হচ্ছে, পাসপোর্ট জালিয়াতির মামলা দায়ের করায় পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে এই চেক দিয়ে ফয়সাল আহম্মেদকে বাগে এনে একটি আপোসরফার ক্ষেত্রফল তৈরি করার কৌশল নিয়েছেন। ফয়সাল আহম্মেদ বিষয়টি নিয়ে আদালতে লড়াই করার প্রস্তুতি নেয়ার একপর্যায়ে নান্না তার কাছ থেকে বলগেট ক্রয় করার নামে ২০ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে নিয়েছিলেন, কিন্তু পরিশোধ না করে একটি চেক দিয়েছিলেন, তা খুঁজে পাওয়া গেলে নান্না বেকায়দায় পরে যায়। কৌশলি নান্না পলাতক অবস্থায় ফয়সালের সাথে আপোষে নানা মাধ্যমে প্রস্তাব দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর চলতি মাসের ২২ তারিখ গোপনে বরিশাল আদালত থেকে জামিন নিয়ে দেখিয়ে দেয়ার হুমকি দেন।
বৃহস্পতিবার ছিল সেই মামলার নির্ধারিত কার্যদিবস। তিনি ফেঁসে যেতে পারেন, এমন আশঙ্কায় অন্তত পাঁচ আইনজীবীকে সাথে নিয়ে নান্না চীফ জুডিশিয়াল আদালতে হাজির হন। অন্যদিকে মামলার বাদী ফয়সাল ও তদন্তকারী কর্মকর্তা এনামুল হক আদালতে উপস্থিত হন। বাদীর পক্ষে বরিশাল আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) জাহাঙ্গীর হোসেন শুনানিতে অংশ নিয়ে নান্নার জালিয়াতির ফিরিস্তি তুলে ধরে বিচারক মারুফ হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি তা আমলে নিলে নান্নার দাবি অনুযায়ি তিনি কিভাবে প্রতারিত হয়েছেন, তার গল্পকাহিনী আর ধোপে টেকেনি। এনিয়ে নান্না তার জীবনদশায় দুই বার কারাভোগ করলেন। এর আগে তিনি চাঁদাবাজির প্রাক্কালে র্যাবের হাতে আটক হয়েছিলেন, কিন্তু তাকে কারাগারে যেতে হয়নি। এবার বাস্তবতা বলছে, প্রচলিত একটি গ্রাম্য প্রবাদের ন্যায় ‘বারবার ঘুঘু তুমি খেয়েছ ধান, এবার তুমি পড়েছ ফাঁদে’।
Leave a Reply